১৩০ বছর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে
‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড-’ অথবা ‘শিক্ষাবিহীন জাতি তলাবিহীন ঝুড়ির মতো’। এই কথাগুলি এখন থেকে ১৩১ বছর আগেই খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন সীতাকুণ্ডের বাড়বকু-ের অধিবাসী আলেমে দ্বীন মরহুম মাওলানা ওবায়দুল হক (র.)। তাই তো তিনি এ এলাকার মানুষকে ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত করতে সে সময়ই স্থাপন করেন উপজেলার অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ সীতাকুণ্ড- আলীয়া (কামিল) মাদ্রাসা। যা আজো সগৌরবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে সবখানে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সীতাকুণ্ড- পৌরসদরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী আলীয়া (কামিল) মাদ্রাসাটি স্থাপিত হয় ১৮৮৬ সালে। উপজেলার বাড়বকু-ের সন্তান মরহুম মাওলানা ওবায়দুল হক কলকাতা থেকে দ্বীনি শিক্ষা শেষে এসে এখানে একটি মাদ্রাসা স্থাপনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এ উদ্যোগ নেন। জানা যায়, যখন এ মাদ্রাসা স্থাপন হয় সে সময়টায় দেশে শিক্ষিত মানুষের হার ছিলো অনেক কম। তার ওপর মাদ্রাসাশিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহও খুব একটা বেশি ছিলো না। ফলে তার জন্য সীতাকুণ্ডে- এ রকম একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা ছিলো রীতিমত চ্যালেঞ্জ। অদম্য ওবায়দুল হক এটি প্রতিষ্ঠা করার পর মাদ্রাসাশিক্ষা বিরোধীরা কয়েকবার এতে আগুন দেয়। তবে তাই বলে এর অগ্রগতি থেমে যায়নি। তিনি শুরু থেকেই সব চ্যালেঞ্জ জয় করে এগিয়ে যেতে থাকেন। ১৮৮৬ সালে পৌরসদরেই আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার পর শুরু থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত এ মাদ্রাসা সুপারের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। অবশ্য শুরুতে বাধা থাকলেও একসময় জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই এ মাদ্রাসার উন্নয়নে এগিয়ে আসেন। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে এখনো। প্রতিষ্ঠাতা ওবায়দুল হকের মৃত্যুর পর ১৯২১ সালে তারই প্রিয়ভাজন মাওলানা মুহম্মদ জামাল উল্লাহ এ মাদ্রাসার সুপার নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। মূলত এ দু’জনের চেষ্টায় মাদ্রাসাটি শিক্ষার ক্ষেত্রে উপজেলার অন্যতম বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়।
সরেজমিনে সীতাকুণ্ড- পৌরসদরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠা বিদ্যাপীঠটি ঘুরে দেখা যায়, ৫ তলাবিশিষ্ট আলীয়া (কামিল) মাদ্রাসায় শ্রেণীকক্ষ আছে ১৮টি। এখানে দেড় হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এদের শিক্ষাদানে নিয়োজিত আছেন ২১ জন শিক্ষক। পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষকদের আন্তরিকতায় এ মাদ্রাসাটি বরাবরই সব পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সুনাম ধরে রেখেছে। এই মাদ্রাসা থেকে পাস করে বহু শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন স্তরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। পরিদর্শনকালে এ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হক পূর্বকোণকে বলেন, এ এলাকার মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত করতে আজ থেকে ১৩১ বছর আগে শিক্ষানুরাগী দানবীর মাওলানা ওবায়দুল হক সীতাকুণ্ডে- আলীয়া (কামিল) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তার সে উদ্দেশ্য শতভাগ সফল হয়েছে। এখন শুধু সীতাকুণ্ডের ছাত্ররা নয়, এখানে পড়াশুনা করতে আসছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থী। দূরাগত শিক্ষার্থীদের জন্য এখানে একটি ছাত্রাবাসও গড়ে তোলা হয়েছে। তিনি বলেন, এখানে শিক্ষক আরো বেশি ছিলো। ২ জন শিক্ষক মারা গেছেন। সব মিলিয়ে ৩/৪টি পদ খালি আছে। সরকারি নিয়ম মেনে পদগুলো পূরণের প্রক্রিয়া চলছে। তবে যে ২১ জন শিক্ষক আছেন তারা আন্তরিকভাবে কাজ করায় পাঠদান যথাযথভাবে চলছে। এ মাদ্রাসার পড়াশুনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রাক্তন ছাত্র সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৯৯-এ আমি এ মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেছিলাম। সে সময় পড়াশুনার যে মান ছিলো, বর্তমানে এর চেয়েও পড়ার মান বেড়েছে বলে আমি জানি। মাদ্রাসার বর্তমান প্রিন্সিপাল, পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দ সবাই খুবই আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। ফলে এখানে নিয়ম-শৃঙ্খলারও উন্নতি হয়েছে। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য আ’লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহআলম পূর্বকোণকে বলেন, সীতাকুণ্ড- আলীয়া মাদ্রাসা উত্তর চট্টগ্রামের একটি বৃহৎ মাদ্রাসা। সীতাকুণ্ডে এটি ছাড়া আর কোন কামিল মাদ্রাসা নেই। এ মাদ্রাসা থেকে অনেক বড় বড় মাওলানা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অপ্রিয় সত্য কথা হলো, এই মাদ্রাসা শুরু থেকে তেমন বড় কোন সরকারি অনুদান পায়নি। বিগত দিনে সাবেক এমপি আবুল কাসেম কিছু অনুদান দিয়ে ভবন নির্মাণে সহায়তা করেন। তবে বেশিরভাগ অনুদানই হচ্ছে ইসলামপ্রিয় মানুষের। এখানে সব আছে। শুধুমাত্র ভবন কম। এ কারণে অনার্স আনা যাচ্ছে। ৩/৪টি বিষয়ে অনার্স আনা জরুরি। এ কারণে বর্তমান সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও থানা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়াসহ কমিটির সদস্যরা এখানে ভবন নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইঞ্জিনিয়ার শাহআলম আরো বলেন, এ মাদ্রাসার নামে ১১ একর ভূমি আছে। সুদীর্ঘকাল আগে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটির ভবন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হক বিভিন্ন জনের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে সহায়তা নিয়ে পূর্বের জরাজীর্ণ ভবন ভেঙে আজকের ৫ তলা ভবনের অবস্থানে নিয়ে আসেন। এখন এটি একটি সুদৃশ্য মাদ্রাসা। প্রিন্সিপাল মাহমুদুল হক মদিনা ও মিশরে পড়াশুনা করেছেন। তার মতো জ্ঞানী চট্টগ্রামের অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই বললেই চলে। তার হাত ধরেই ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠটি আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। -সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি, সংবাদ প্রতিদিন।
No comments