সিটি নয়, বিএনপি ব্যস্ত জাতীয় নির্বাচনে
সিলেটে বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক তৎপরতা আবর্তিত হচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে। গত রমজানে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ইফতার মাহফিলে সীমাবদ্ধ ছিল সাংগঠনিক কার্যক্রম। ঈদের পর শুরু হয়েছে সদস্য সংগ্রহ অভিযান। তা ছাড়া জেলার ছয়টি আসনেই দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, প্রায় এক যুগ পর জেলা ও মহানগর বিএনপির সম্মেলন হলেও কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তবে সেই অসন্তোষ কাটিয়ে দল গুছিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, সিলেটে বর্তমানে বিএনপির প্রধান টার্গেট আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন থাকলেও সিলেটে দলের মেয়র থাকায় এ নিয়ে খুব একটা ভাবছেন না তাঁরা। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত দলটি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা একাধিকবার সিলেটে এসে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেও গেছেন।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, ‘এক কথায় বলতে হলে বলব, সিলেটে বিএনপির সব কার্যক্রম এখন নির্বাচনমুখী। দলের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করে আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থীকে জয়ী করতে বিএনপি কাজ করছে। ’
সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন জানান, মূলত সংগঠনকে গুছিয়ে শক্তিশালী করা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন—এই দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই তাঁরা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। দলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে ১০ জুলাই থেকে সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করার কথাও তিনি জানান।
জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-১ আসনটি অবশ্য মর্যাদাপূর্ণ। এ আসনে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করেন সেই দলই সরকার গঠন করে—এমনটিই চলে আসছে স্বাধীনতার পর থেকে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি নেতারা জানান, ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে শুধু সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মালিক জয়ী হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে বাকি ১৮টি আসনে দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হলেও সরকার গঠন করেছিল বিএনপি। তাই রাজনৈতিক দলগুলো এই আসনকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সঙ্গত কারণে বিএনপির চোখ এই আসনটির দিকে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর সিলেট-১ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ধরা হচ্ছিল সমশের মুবিন চৌধুরীকে। কিন্তু তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে শোনা গেছে বিভিন্নজনের নাম। এর অন্যতম তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমান। পরে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এই আসনে নির্বাচনে লড়বেন বলে জোর গুঞ্জন চলছিল। এ অবস্থায় এবারের রমজানে জেলা বিএনপির ইফতার মাহফিলে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ সিলেট-১ আসনে খালেদা জিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টি নাকচ করে দেন। তিনি বলেছেন, এখানে স্থানীয় কোনো নেতা নির্বাচন করবেন।
এরপর থেকেই সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী ধরা হচ্ছে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মোক্তাদিরকে। ১৯৯১ সালে সিলেট অঞ্চলে দলের একমাত্র বিজয়ী সংসদ সদস্য মরহুম খন্দকার আব্দুল মালিকের ছেলে মোক্তাদির শুরুতে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও কয়েক বছর ধরে তিনি সিলেটের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। ভদ্র, বিনয়ী এবং পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতা হিসেবে তাঁর আলাদা পরিচিতি আছে।
একইভাবে সিলেট-২ আসনে বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা, সিলেট-৪ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিম, সিলেট-৫ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল কাহির চৌধুরী দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য আসনেও একাধিক প্রার্থী রয়েছে বিএনপির হাতে। তাঁদের থেকে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়নের প্রাথমিক কাজ এখন চলছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
কমিটি নিয়ে অসন্তোষ : দলীয় সূত্র জানায়, সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হয়েছিল ২০০৪ সালে। এক যুগ পর গত বছর জেলা ও মহানগর বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ চারটি এবং মহানগর কমিটির তিনটি পদে নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৪ মাস পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। সবাইকে খুশি করতে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে বিশাল আকারের কমিটি দেওয়া হলেও শুরুতেই কমিটি নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়।
গঠনতন্ত্র অনুসারে জেলা ও মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটির আকার হবে ১৫১ সদস্যের। কিন্তু জেলা বিএনপির কমিটিতে স্থান পেয়েছেন ২৮৫ জন আর মহানগর বিএনপিতে ২৩১ জন। এর বাইরে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা কমিটিতে ৮২ জন এবং মহানগর বিএনপির উপদেষ্টা কমিটিতে ৫০ জন স্থান পেয়েছেন।
দলীয় গঠনতন্ত্র অনুসারে, কমিটিতে সহসভাপতি পদে ১৫ জন থাকার কথা। কিন্তু সিলেট জেলা বিএনপির কমিটিতে এ পদে ৩৩ জন এবং মহানগর কমিটিতে আছেন ২২ জন। এ ছাড়া দুই কমিটিতেই জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করা হয়নি বলেও অভিযোগ ওঠে।
কমিটি প্রকাশের পর দলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। যাঁরা পদ পাননি তাঁদের চেয়ে যাঁরা পদ পেয়েছেন তাঁরাই বেশি সমালোচনা করেন। জেলা বিএনপির সহসভাপতির দায়িত্ব পাওয়া মামুনুর রশীদ মামুন এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘এ কমিটির বিশাল পদের চেয়ে বিএনপির একজন কর্মী হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করি। যেখানে গঠনতন্ত্র না মেনে, সাংগঠনিক বিষয়াদি না মেনে কমিটি হয়েছে, সেখানে কমিটির পদ নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। ’
মহানগর বিএনপির সহসভাপতি পদ পাওয়া ফরহাদ চৌধুরী শামীম বলেন, ‘কমিটিতে যে পদ পেয়েছি তাতে যতটুকু আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল, ‘ঢাউস’ কমিটি দেখে তাতে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি। এত দিন কর্মীবান্ধব দল ছিল বিএনপি, এখন সেটি নেতাবান্ধব দলে পরিণত হলো। ’
দল গোছানোতেই প্রাধান্য : নেতাকর্মীদের এই ক্ষোভ-বিক্ষোভের পরও দলকে গুছানোর কাজকেই প্রাধান্য দিচ্ছে স্থানীয় বিএনপি। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ স্পষ্ট করেই জানান, তাঁদের যত তৎপরতা সব নির্বাচন এবং দল গুছানোকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ আসনে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বন্যার্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন বলেও তিনি জানান।
গত ৮ জুলাই থেকে জেলা বিএনপির সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন অভিযান শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে এ কাজ চলছে। সিলেট জেলায় প্রায় দুই লাখ সদস্যের টার্গেট নিয়ে তাঁরা এগোচ্ছেন।
তবে দলে কমিটি নিয়ে অসন্তোষ নেই দাবি করে আলী আহমদ বলেন, দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করে কেন্দ্রের সম্মতিতেই এবার বড় আকারের কমিটি হয়েছে।
No comments