শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এ বছরই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা সিরিসেনা। |
বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ২০১৭ সালেই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করবে। গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনা ও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা সিরিসেনার নেতৃত্বে দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে উভয় পক্ষ এ সম্মতির কথা জানায়। পরে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ১৪টি দলিল সই করে। এগুলোর মধ্যে ১৩টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও একটি চুক্তি। দুই দেশের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের ভিসা অব্যাহতি-সংক্রান্ত একমাত্র চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবি করুণানায়েকে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক ও চুক্তি সই অনুষ্ঠানের পর পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ’
শহীদুল হক জানান, বর্তমানে কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নেই। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ চুক্তি হলে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এফটিএর অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবে। উভয় দেশ যত দ্রুত সম্ভব এ চুক্তির জন্য সব আলোচনা ও সমীক্ষা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের সিদ্ধান্ত দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্যে ‘রূপান্তর’ চলছে। তাই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ওপরই এখন বেশি জোর দিতে হচ্ছে।
পররাষ্ট্রসচিব আরো বলেন, অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে দুই দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কৃষি। যে ১৪টি দলিল সই হয়েছে এর মধ্যে সাতটিই কৃষি, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যবিষয়ক। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের কৃষি খাত বিশেষ করে বীজ উৎপাদনের সাফল্য থেকে শিখতে চায়।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, সই হওয়া চুক্তি ও এমওইউ এবং দুই দেশের যৌথ বিবৃতির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি কাঠামো দাঁড়িয়েছে। এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রীলঙ্কার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে শিক্ষা খাতেও সহযোগিতার জোরালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট তাঁর এ সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, এর ফলে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুরু হবে।
দুই দেশের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য সই হওয়া ‘ভিসা অব্যাহতি চুক্তি’কে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের সফরের বড় অর্জন হিসেবে পররাষ্ট্রসচিব অভিহিত করেন। পররাষ্ট্রসচিবের এ ব্রিফিংয়ের সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম ও শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহও উপস্থিত ছিলেন।
স্বাক্ষরিত এমওইউগুলো হলো—কৃষি খাতে সহযোগিতা, সিলন শিপিং করপোরেশন (সিএসসি) ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মধ্যে এমওইউ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) ও লক্ষণ কাদিরাগামা ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (এলকেআইআইআরএসএস) মধ্যে আন্তর্জাতিক ও কৌশলগত সমীক্ষা, উচ্চশিক্ষা খাতে সাহায্য-সহযোগিতা বিষয়ে দুই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মধ্যে এমওইউ, বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমি (এফএসএ) ও বন্দরনায়েকে ডিপ্লোমেটিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (বিআইডিটিআই) মধ্যে এমওইউ, আর্থিক খাতে সহযোগিতা বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার মধ্যে এমওইউ, বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) ও ইনভেস্টমেন্ট অব শ্রীলঙ্কার মধ্যে এমওইউ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও শ্রীলঙ্কা স্ট্যান্ডার্ডস ইনস্টিটিউশনের (এসএলএসআই) মধ্যে এমওইউ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ও শ্রীলঙ্কান ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি লঙ্কাপুভাত লিমিটেডের মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ে এমওইউ, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে রেডিও, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন খাতে সহযোগিতা, চিটাগাং বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (সিবিআইএফটি) ও শ্রীলঙ্কা ইনস্টিটিউট ফর অ্যাপারেল অ্যান্ড টেক্সটাইলসের (এসএলআইটিএ) মধ্যে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক।
শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবি করুণানায়েকে, কৃষিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ওয়াসান্থা আলুউইহারে, বন্দর ও জাহাজ চলাচলবিষয়ক উপমন্ত্রী নিশান্থ মুথুয়েত্তিগামা, মহাসড়ক ও উচ্চশিক্ষা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লাল গ্রেরো, গণমাধ্যম ও অর্থবিষয়ক উপমন্ত্রী লাসান্থা আলাগইয়াওনা ও বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার ইয়াসোজা গুনাসেকেরা তাঁদের দেশের পক্ষে দলিলগুলো সই করেন।
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম ও বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশের পক্ষে দলিলগুলো সই করেন।
উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট তিন দিনের সফরে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা আসেন। প্রথম দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী বীর শহীদদের প্রতি এবং ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল শুক্রবার বিকেলে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাদাভাবে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সন্ধ্যায় সিরিসেনা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নেন।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট তাঁর তিন দিনের সফরের শেষ দিন অর্থাৎ আজ শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এমসিসিআই ও বিডার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ব্যবসা সংলাপে’ বক্তব্য দেবেন। এরপর দুপুর ১টার দিকে তিনি শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন।
No comments